‘অগ্নিঝুঁকিতে’ নারায়ণগঞ্জ, ২৪৪৪টি অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১৫২

নারায়ণগঞ্জে চার বছরে ২ হাজার ৪৪৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী-শিশু সহ ১৫২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতি বছর গড়ে ৬ শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে এ জেলায়। এতে নারায়ণগঞ্জ জেলাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করছেন ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। এছাড়া এই শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় গড়ে ওঠা কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। ফলে এ জেলায় ফায়ার ব্রিগেডের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে ৫৯৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩৯ জন, ২০২১ সালে ৬৯৪ টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৫৪ জন, ২০২২ সালে ৫৯৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা শূন্য, ২০২৩ সালে ৫৬৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪ জন নিহত হয়েছেন। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২৪৪৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৯৭ জন নিহত হয়েছেন। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কেউ দগ্ধ বা আহত হয়ে জেলার বাইরে কোন হাসপাতালে গিয়ে মারা গেলে সেই সংখ্যা তাদের তালিকায় যুক্ত হয়না।

এদিকে গত চার বছরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত জেলার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ২০২০ সালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪২ জন, ২০২১ সালে ৭০ জন, ২০২২ সালে ৮ জন ও ২০২৩ সালে ৩২ জন বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন। সে হিসেবে এই চার বছরে ১৫২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। প্রাণহানির এসব ঘটনায় অনেকে নারায়ণগঞ্জ জেলার বাহিরে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার তথ্যও উঠে এসেছে।

এ জেলায় সবচেয়ে বেশি অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে শহরের নয়ামাটি হোসিয়ারি এলাকা, ফতুল্লা পঞ্চবটি এলাকার বিসিক শিল্প নগরী, সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী ইপিজেড সহ বিভিন্ন এলাকা। এসব শিল্পাঞ্চল এলাকা ও তার আশেপাশে লাখ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এরুপ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে অনেক বেগ পোহাতে হয়। ঘিঞ্জি এলাকা, অপ্রশস্ত সড়ক, ভবনের সরু সিঁড়ি, বহুতল ভবন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে যথাযথ পানির রিজার্ভার না রাখা সহ নানা সংকটের কথা জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস। ফলে এরুপ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের মত ঘটনা ঘটলে বিপুল পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে ফায়ার সার্ভিস।

২০২৩ সালে ৩ নভেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের আউখাবো বাজার এলাকার একটি বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একই পরিবারের পাঁচজন দগ্ধ হন। তাদের উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একে একে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- আলী আহমেদের (৬৩), শাহেরা আক্তার (২৪) ও মো. সোনা মিয়া।

২০২১ সালের ৮ জুলাই রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানার ছয়তলা ভবনে আগুন দেখে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিন জনের মৃত্যু হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ১৯ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে আগুনে পুড়ে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে ৫৪ জন শ্রমিক-কর্মচারী নিহত হয়েছেন। এমনকি অনেকের লাশ পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে, যা পরবর্তীতে ডিএনএ টেস্ট করার মধ্য দিয়ে শনাক্ত করা হয়েছে।

২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজ পড়ার সময় জমে থাকা গ্যাস থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের ভেতরে থাকা মানুষের শরীর ঝলসে যায়। কারও কারও শরীরে কোনো কাপড়ই ছিল না। এরপরেই এলাকাজুড়ে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। ঝলসে যাওয়া ৩৭ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে কয়েকজন সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারলেও ৩৪ জন প্রাণ হারান।

এসব ঘটনার কারণ হিসেবে তিতাসের লাইনের ত্রুটি, সিলিন্ডার গ্যাস, বয়লার ও এসি বিস্ফোরণ, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট সহ নানা বিষয়কে উল্লেখ করছেন ফায়ার সার্ভিস সহ সংশ্লিষ্টরা।

এই জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এর উপ সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের ফায়ার ব্রিগেড (ফায়ার স্টেশনের) সংখ্যা বেড়ে গিয়ে ১০টি হয়েছে। আগামীতে আরও দুটি ফায়ার ব্রিগেড এর সংখ্যা বাড়বে। সারা দেশে ১১টি মডেল ফায়ার ব্রিগেড রয়েছে, তার মধ্যে দুটি নারায়ণগঞ্জে রয়েছে। নারায়ণঞ্জে ফায়ার ব্রিগেডকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এর কারণ হলো- নারায়ণগঞ্জ অন্যান্য জেলার চেয়ে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৯ সালের পরে এ জেলায় ৫টি ফায়ার ব্রিগেড থেকে বাড়িয়ে ১০টি করা হয়েছে। এছাড়া এ জেলায় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা সহ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ার ফলে এ জেলা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বটে। আয়তনে ছোট এ জেলাতে জনসংখ্যা অনেক বেশি। এসব কারণে ফায়ার ব্রিগেডের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।

সরু সড়কের ফলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাতায়াতে বিলম্ব হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ একটা পুরাতন শহর, এখানে শত বছরের পুরাতন ভবনও রয়েছে। এসব ভবনে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। এসব সার্ভিসের লাইন লিক হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। গত বছর নিতাইগঞ্জে একটি পুরাতন ভবনে গ্যাস লিকেজ থেকে বিষ্ফোরণ হয়ে ভবনটি ধসে পড়েছে। এতে বেশি কিছু লোক নিহত হয়েছে। নিতাইগঞ্জ, দেওভোগ, টানবাজার সহ এরুপ এলাকায় সরু সড়কের ফলে আমাদের ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাতায়াত করতে পারেনা। এতে করে আমাদের গৌন্তব্যে পৌঁছতে বিলম্ব হয়ে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। আর নতুন ভবন তৈরির ক্ষেত্রে বিকল্প সিড়ি, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা রাখা জরুরী। এর পাশাপাশি সবাইকে সচেতন হতে হবে।

গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নারায়ণগঞ্জের মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশীদ বলেন, অনেক সময় গ্রাহকদের অসচেতনায় গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে এসব ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কারণ গ্যাস লাইনের বাইরের অংশে কোন লিকেজ থাকলে তা দেখভালের দায়িত্ব তিতাস কর্তৃপক্ষের। কিন্তু গ্যাস লাইন ব্যবহারে গ্রাহকের ভবনের যে পাইপের সংযোগ থাকে সেটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহকের। তবে আমাদের লাইনের কোন ত্রুটি বা লিকেজ রয়েছে এমন খবর পাওয়া গেলে, দ্রত সময়ে মধ্যে তা মেরামত করা হয়ে থাকে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জেলার সভাপতি সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল বলেন, বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে সবাই নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন পর সবাই ভুলে যায়। ফলে স্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়না। শহরের নয়ামাটি সহ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আগুন লাগলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের শহর ও শহরের আশেপাশের সড়কগুলো আরও প্রশস্ত করা প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। তবে এসব বিষয় একদিনে সমাধান করা সম্ভব নয়। অতিদ্রুত এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।